যশোর জেলা ও এর উপজেলা সমূহের নামকরণের ইতিহাস


যশোর নামের উৎপত্তি অনেক কথা প্রচলিত আছে; এখন যে শহরকে যশোর বলে তা থেকে প্রাচীন যশোর নগরী বহুদূরে অবস্থিত। প্রাচীন সেই প্রকৃত যশোহর এখন খুলনার মধ্যে। সে যশোর এক প্রাচীন স্থান এবং সেস্থান যে রাজ্যের মধ্যে সংস্থিত, তারও নাম যশোর। এর নাম যশোর কেন হলো, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। আরবী জসর বা যশোর শব্দের অর্থ সেতু বুঝায়। যশোর জনবহুল দেশ বলে এই অর্থে তার নামোৎপত্তি হয়েছে, এটাই সুপ্রসিদ্ধ কানিংহাম সাহেবের ধারনা।  (The Name of Jasar, the bridge, shows the nature of the country which is completely intersected by deep water course) কিন্তু মুসলমান অধিকারের পূর্ব থেকে যশোর নামের উল্লেখ দেখা যায়।  যশোর একটি পীঠ স্থান; পীঠ স্থানের তালিকায় যশোরের নাম আছে।
‘যশোরে পাণিপদ্মঞ্চ দেবতা যশোরেশ্বরী।
চণ্ডশ্চ ভৈরবো যত্র তত্র সিদ্ধিমবাপ্লুয়াৎ।। -তন্ত্রচূড়ামণি
 অন্যান্য প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থে যেখানে যশোর রাজ্যের প্রসঙ্গ আছে, সেখানে যশোর নামাই দেখা যায়, যশোহর নাম নেই। প্রতাপদিত্য এই যশোর রাজ্যের রাজা হয়েছিলেন। বর্তমান খুলনা জেলার দক্ষিণাংশে অবস্থিত কালীগঞ্জ থেকে ১২ মাইল দক্ষিণে সুন্দরবন অঞ্চলে তার রাজধানী ছিল।  সে রাজধানীর নামও যশোর।
‘যশোর নগর ধাম, প্রতাপ আদিত্য নাম,
মহারাজা বঙ্গজ কায়স্থ। -ভারতচন্দ্র কৃত অন্নদামঙ্গল
এই রাজধানীর অন্তর্গত ইশ্বরীপুর নামক স্থানে এখন যশোরেশ্বরী দেবীর পীঠ মন্দির ও মূতি আছে। প্রতাপাদিত্যের পিতা বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে প্রথম ‘যশোহর’ নাম হয়। যশোরে বনস্থালী আবাদ করে সেখানে নগরী স্থাপনের সময় প্রতাপাদিত্যের খুল্লতাত সুকবি বসন্তরায় যশোরকে যশোহর করেছিলেন, এটাই বিশ্বাসযোগ্য এবং এমন প্রবাদও প্রচলিত আছে।বঙ্গের শেষ পাঠান নৃপতি দায়ুদশাহ মোঘলদের কাছে পরাজিত হয়ে পালানোর সময় রজাধানী গৌড় ও তাণ্ডার অধিকাংশ রাজকীয় ধনরত্ন বিক্রমাদিত্যের হাতে সমর্পণ করেন। কেউ কেউ এমন অনুমান করেন যে, নতুনপ্রতিষ্ঠিত যশোরনগরী এভাবে গৌড়ের যশ: হরণ করে বলেই এর নাম হয়েছিল- যশোহর।
আবার কেউ বলেন যে, গৌড়ের সাথে তুলনা না করেই কোন ব্যক্তি এ রাজ্য ‘অত্যাধিক যশস্বী’-এই অর্থে ‘যশোহর’ নাম দিয়েছিলেন।
‘It was intended to express the idea ‘Supermely glorious.” –Westland’s Report on the district of Jessore, 1871.
কিন্তু যশোর নাম নতুন দেওয়া হয়নি।  পূর্বে এর একটা নাম ছিল এবং সে নাম যশোর।
রামরাম বসুর মতে, দক্ষিণ দেশে যশহর নামে এক স্থান ছিল। নাম যশোর বা যশহর যাই থাকুক তাতে বিশেষ অর্থ হতো না। এজন্য বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে তাকে বিশুদ্ধ ও অর্থসঙ্গত করার জন্য ‘যশোহর’ নামকরণ করা হয়ে থাকবে। তখন থেকে পণ্ডিত ও কুলাচার্য্যগনের উক্তিতে যশোহর নাম দেখা যায়।
পণ্ডিত-রচিত কবিতায়-যশোহরপুর
ী কাশী দীর্ঘিকা মণিকর্ণিকা।
ঘটক কারিকায়-‘সেনাপতিরূপা বা যশোহরসুরক্ষকা’।
অনত্র- ‘রাজবিপ্লবেন গৌড়ৎ যশোহরং সমাগত:।
তবুও সে পর্যন্ত যশোর ও যশোহর শব্দ এক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
প্রতাপের পরাজয়ের পর বিজয়ী মানসিংহ বসন্তরায়ের পুত্র কচুরায় বা রাঘবকে ‘যশোরজিৎ’ উপাধি দেন। যশোরের রাজ্য শাসনের জন্য যে একজন ফৌজদার নিযুক্ত হন তাকে যশোরের ফৌজদার বলা হতো। ১৭৮১ খৃস্টাব্দে শান্তিরক্ষার জন্য ফৌজদারদের মত একজন শাসক বা ম্যজিস্ট্রেট নিযুক্ত করা হয়। তখন যে অফিস আদালত হলো, তাকে মুড়লীর কাছারীও বলত, যশোরের কাছারীও বলত। ১৭৮৯ খৃস্টাব্দে এসব কাছারী পাশ্ববর্তী কসবা বা সাহেবগঞ্জে স্থানান্তরিত হলে ঐ স্থানের নাম হলো যশোর বা Jessore. সাধারণভাবে লোকে একে যশোর বলত এবং বাংলা ভাষার বিশুদ্ধ করার জন্য যশোহর লেখা হতো।
যশোর জেলার উপজেলা সমুহঃ মণিরামপুর, অভয়নগর, বাঘারপাড়া, চৌগাছা, ঝিকরগাছা, কেশবপুর, যশোর সদর, শার্শা।
মনিরামপুর উপজেলাঃ
ধারণা করা হয়, মণি এবং রাম নামের দুই ভাইয়ের নামে নামকরণ করা হয়েছে মণিরামপুর। যশোরের কবি-সাহিত্যিকদের তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, চাঁচড়ার রাজ সীতারাম মণি ও রাম নামের দু’জন দূতকে নিয়ে তৎকালীন যশোরের 20 কিমি দক্ষিণের এই জনপদ পরিদর্শন করেন। এই মণি ও রামের নামানুসারে এই জনপদের নাম হয়েছে মণিরামপুর। আবার কারো কারো মতে, স্থানীয় প্রভাবশালী জমিদার মণিরাম বাবুর নামানুসারে এই এলাকার নাম হয় মণিরামপুর।
অভয়নগর উপজেলা
১৮৭৫ খিস্টাব্দের ১৬ ই মার্চ অভয়নগর মৌজায় তৎকালীন রাজা প্রতাপাদিত্যের কন্যা রানী অভয়ার নামানুসারে বাঘুটিয়া ইউনিয়নের অভয়নগর মৌজাতে অভয়নগর থানা সদর প্রতিষ্ঠিত হয়্ এর থেকে অভয়নগর উপজেলার নামকরন হয় অভয়নগর।
বাঘারপাড়ার ইতিহাস
কেবল বাঘারপাড়া নয়, এই শতকের তৃতীয় দশকেও যশোর খড়কীসহ অনেক অঞ্চল জংগলে পরিপূর্ণ ছিল। চিত্রার পাড়ের বাঘের পায়ের ছাপ দেখা যেতো। এ থেকেউপজেলার নাম  বাঘেরপাড়া।
চৌগাছার উপজেলা
চৌশব্দের অর্থ চার আর গাছা শব্দের অর্থ গাছ। অর্থাৎ চারগাছের সমাহার চৌগাছা আবার কেউ কেউ মনে করেন  চার  রাস্তার সমাহার  চৌগাছা। করগাছার প্রাচীন জনপদ গদখালী।জেনকিনস  সাহেব এখানে নীল কুঠি স্থাপন করার  পর  আর এক ইংরেজ ম্যাকানজি সাহেব নীল কুঠির সাথে অন্যান্য কলকারখানা স্থাপন করে গদখালীর উন্নয়ন সাধন করেন। এই জন্যে ম্যাকানজি সাহেবকে ঝিকরগাছার রুপকার বলা হয়।ঝিকরগাছার অপর নাম ম্যাকানজি গঞ্জ। ১৮৬৩ 
সালে  কপোতাক্ষ  নদের  পশ্চিম  পাড়  যশোর  জেলার  অন্তর্ভূক্ত হয় এবং গদখালীকে যশোরের  একটি থানা করার  প্রয়োজন হয় গদখালীতে পানীয় জলের অভাবের কারণে যশোরের দিকে  ২ মাইল পিছিয়ে বেনেয়ালীতে  গদখালীর  নামেই গদখালী থানা স্থাপন করা হয়।  বেনেয়ালীতে ছিল গভীর বন চোর ডাকাতদের অভয়াশ্রম।ম্যাজিষ্ট্রেট  বিনফোর্ট  এর নেতৃত্বে এ অভয়াশ্রম ধ্বংশ করা হয়।পরবর্তীতে সুবিধামত কোন এক সময়ে যশোর  কোলকাতা সড়কের  কপোতাক্ষ  নদের উভয়  পাশে বাজার  গড়ে উঠায় থানা  বেনেয়ালী থেকে  বর্তমান স্থানে  চলে আসে  অর্থাৎ  ঝিকরগাছায়।
ঝিকরগাছা উপজেলাঃ
সতের শতকে ফরাসি বেনিয়া জুনেট সাহেব কপোতাক্ষ নদের তীরে ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে তোলেন। তারই নামানুসারে এই অঞ্চলটি জানটি নগর নামে পরিচিত ছির। ব্রিটিশ আমলে জেংকিন্স সাহেবের নাম ছিল ঝিনকার (Mr. Jhinker) পরে সেই ঝিনকার সাহেবের নামানুসারে জুনেট নগরের নাম পরিবর্তিত হয়ে ঝিনকারগাছা হয়। সেই ঝিনকারগাছা কালের বিবর্তনে ঝিকরগাছা নামে পরিচিতি লাভ করে। 
কেশবপুর উপজেলাঃ
বলা হয়ে থাকে, কেশবচন্দ্র উপজেলার বর্তমান এলাকায় বাস করতেন। স্থানীয় লোকজনের মতে কেশবচন্দ্রের নামানুসারে এ এলাকার নাম হয়, কেশবপুর।
শার্শা উপজেলাঃ
শার্শা গ্রামের নামকরণ সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য নেই।

যশোর জেলা ও এর উপজেলা সমূহের নামকরণের ইতিহাস যশোর জেলা ও এর উপজেলা সমূহের নামকরণের ইতিহাস Reviewed by sm sohage on July 31, 2018 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.