বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের নামকরণ ইতিহাস

নামকরণঃ


ঢাকা শহরে আলাদা স্টেডিয়াম নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ব্রিটিশ আমলেই। চল্লিশের দশকে যা বাস্তবায়িত হয়। নামকরণ করা হয় পল্টন খেলার মাঠ।  পরে তা বদলে হয়ে যায় ঢাকা স্টেডিয়াম। ব্রিটিশ আমলে ঢাকা জুড়েই ছিল মাঠের ছড়াছড়ি। কিন্তু আরমানিটোলা মাঠ পাকিস্তান আমলে যা ‘পাকিস্তান মাঠ’ বলেই পরিচিতি লাভ করে। স্বাধীনতার পর আবার নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ মাঠ’। ওই সময় ঢাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো খেলার মাঠ ছিল আরমানিটোলাতেই। ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, ভলিবল সব রকমই খেলা হতো এখানে। গেন্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠেও ছিল খেলার ছড়াছড়ি।  ১৯৯৬ সালে ঐতিহাসিক ঢাকা স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম’।


স্টেডিয়াম সম্পর্কে ঃ


৪০ এর দশকে স্টেডিয়াম হলেও ওই সময়ে কোনো পাকা গ্যালারি ছিল না। কাঠের গ্যালারিতে বসেই দর্শক খেলা দেখত। পাকিস্তান আমলে পুরো গ্যালারি দোতলা ছিল না। স্বাধীনতার পর পুরো গ্যালারি দোতলায় রূপান্তরিত হয়।  লাগানো হয় ফ্লাডলাইট।’


১৯৪৭ সালের শুরুতেই এখানে ঢাকার বিভিন্ন মহল্লাকে নিয়ে ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়েছে। কিন্তু ঢাকা প্রথম বিভাগ লিগের যাত্রা হয় ’৪৮ সালে। অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এখানে নিয়মিত ফুটবল লিগ হচ্ছে।  ১৯৪৮ থেকে ২০১৭ অর্থাৎ ৬৯ বছরে এই স্টেডিয়ামে কি শুধু ফুটবলই হয়েছে? মোহামেডান-আবাহনীর লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ ছিল কি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম?


১৯৪৭ সালে তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) ঢাকা ফুটবল লিগের যাত্রা হলেও ব্রিটিশ আমলে হিন্দু জমিদাররা মিলে তার আগেই ধূপখোলা মাঠে ঢাকা লিগ শুরু করেন। যদিও এই তথ্য সঠিক কিনা তা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। তবে ব্রিটিশ আমলে ঢাকার বড় মাঠ বলতে আরমানিটোলা ও ধূপখোলাকেই বোঝাত। বিভিন্ন লেখকের বইয়ে ঢাকার ইতিহাস পড়লে তারই প্রমাণ মেলে।


এখানেই তো পৃথিবীর অন্য স্টেডিয়ামের চেয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়।  সাঁতার ছাড়া এমন কোনো খেলা নেই যে এখানে হয়নি।  শুধু কি খেলা, মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গেও ঢাকা স্টেডিয়ামের নাম জড়িয়ে আছে। ’৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ভারতীয় মিত্রবাহিনী। ’৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর মিত্রবাহিনীকে বিদায় জানান ঢাকা স্টেডিয়াম থেকেই। এ ঐতিহাসিক দৃশ্য দেখতে পুরো গ্যালারি ভরে গিয়েছিল। মিত্রবাহিনীকে বিদায় জানাতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু।  আবেগময় বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘রিক্ত আমি, সিক্ত আমি দেওয়ার কিছু নাই/আছে শুধু ভালবাসা দিয়ে গেলাম তাই’ পাঠের সময় বঙ্গবন্ধুর চোখ ছলছল করছিল।  গ্যালারির দর্শকরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। ঢাকা স্টেডিয়ামের সেই ঐতিহাসিক দিনের কথা কখনো ভোলার নয়।


ঢাকা স্টেডিয়ামের ক্রিকেটার রকিবুল হাসানের দুঃসাহসিক দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। ’৭১ সালে সারা দেশে তখন আন্দোলন তুঙ্গে। পাকিস্তান আর্মিরা যাকে পাচ্ছে তাকেই গ্রেফতার করছে। সেই সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিক একাদশের চার দিনের ম্যাচ। ২৬ ফেব্রুয়ারি ম্যাচের প্রথম দিনেই তরুণ রকিবুল ঘটালেন দুঃসাহসিক ঘটনা। ভিআইপি গ্যালারি থেকে ব্যাটিংয়ে নামছেন তিনি। ব্যাটে দেখা গেল জয় বাংলা স্লোগানের স্টিকার লাগানো। এই দৃশ্য দেখে দর্শকরা বিপুল করতালি দিয়ে রকিবুলকে অভিনন্দন জানান। সেই দিনের স্মৃতিচারণা করে রকিবুল বলেন, ‘আমি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ব্যাটে জয় বাংলা স্টিকার লাগিয়ে পাকিস্তানিদের প্রতিবাদ জানাব। আমি হোটেল পূর্বাণীর ৭১০ নম্বর রুমে ছিলাম। বন্ধু শেখ কামালসহ অনেকে ম্যাচের আগের দিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। কামালকে বললাম আমাকে জয় বাংলা লেখা স্টিকার জোগাড় করে দাও। আমি তা ব্যাটে লাগিয়ে মাঠে নামব। অনেকে বাধা দিয়ে বললেন, “খবরদার! এই কাজ করো না। মাঠেই গ্রেফতার হয়ে যাবে।” আমি বললাম, পারলে ওরা আমাকে মেরে ফেলুক তবু পাকিস্তানিদের বর্বরতার প্রতিবাদ জানাব। কামাল আমাকে সাহস দিলেন, বললেন, বন্ধু! তুমি দেখিয়ে দাও আমরা সাহসী জাতি। জয় বাংলা লেখা দেখে গ্যালারিতে সে কী উল্লাস। এই দৃশ্য দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। অনেক হুমকি এসেছে কিন্তু আমি ভয় পাইনি। বলেছি আমি বাঙালি, মৃত্যুকে পরোয়া করি না।’


ঢাকা স্টেডিয়ামে গ্যারি সোবার্স, হানিফ মোহাম্মদ, মুশতাক মোহাম্মদ, আসিফ ইকবাল, জহির আব্বাসদের মতো কিংবদন্তি ক্রিকেটার টেস্ট খেলেছেন। খেলেছেন হকিরও বিশ্ব তারকারা। ফুটবলে প্রথম বিভাগ লিগ ছাড়াও আগা খান গোল্ডকাপ, প্রেসিডেন্ট কাপ হয়। ১৯৮১ সালে এই টুর্নামেন্ট উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তার আগে ’৭৮ সালে এশিয়ান যুব ফুটবলের জমজমাট আসর বসেছিল।  হয়েছে জাতীয় অ্যাথলেটিক্স, সাইক্লিং, ভলিবল, আন্তর্জাতিক কুস্তি প্রতিযোগিতা, হ্যান্ডবল, কাবাডি। ’৭৮ সালে কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলী ঢাকা সফরে এসে ঢাকা স্টেডিয়ামে এক প্রদর্শনী বক্সিংয়ে অংশ নেন।


৮৫ সালে এশিয়া কাপ হকি ও ’৮৮ সালে এশিয়া কাপ ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হয়।  ’৮৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও ’৯৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঢাকা স্টেডিয়ামে সাফ গেমসের উদ্বোধন করেন। কতই না ঘটনা ঘটেছে এখানে। স্মৃতিভারে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম; যা পৃথিবীর কোনো ভেন্যুতে দেখা মেলেনি।


দেশের ১ নম্বর স্টেডিয়াম। ’৯৮ সালে এখানে অনুষ্ঠিত হয় ক্রিকেটে নক আউট বিশ্বকাপ, ২০০০ সালে বাংলাদেশ অভিষেক টেস্ট খেলে এখানেই। কত ওয়ানডে ও টেস্ট বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে হয়েছে তার হিসাব মেলানো মুশকিল। ’৯৮ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের নাম পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। শচীন টেন্ডুলকার, ওয়াসিম আকরাম, অর্জুনা রানাতুঙ্গা, জয়সুরিয়া বলেছেন তাদের প্রিয় ভেন্যুর মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম অন্যতম। ২০১১ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোনো ম্যাচ না হলেও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের বর্ণাঢ্য উদ্বোধন হয়। হয় যুব বিশ্বকাপ ক্রিকেট, এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। বঙ্গবন্ধু কাপ ফুটবলেরও অভিষেক ঘটে এখানেই। ফুটবলে জাকারিয়া পিন্টু, আবদুস সাদেক, গোলাম সারওয়ার টিপু, প্রতাপ হাজরা, মনোয়ার হোসেন নান্নু, কাজী সালাউদ্দিন, শামসুল আলম মঞ্জু, এনায়েত, সালাম মুর্শেদী, বাদল রায়, শহিদুর রহমান শান্টু, শেখ মো. আসলাম, কায়সার হামিদ, সাব্বির, মোনেম মুন্নারা তারকা খ্যাতি পান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে খেলেই। ক্রিকেটে শফিকুল হক হীরা, রকিবুল হাসান, লিপু, নান্নু, আকরাম, দুর্জয়, সুজন, পাইলট, এমনকি মাশরাফি এবং আশরাফুলও তারকা খ্যাতি পান এ স্টেডিয়াম থেকেই।


২০১১ সালে লিওনেল মেসির নেতৃত্বে ’৮৬-এর বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে অংশ নেয়। এ ছাড়া ২০০৬ সালে মাঠে নেমেছিলেন ফ্রান্সের কিংবদন্তি ফুটবলার জিনেদিন জিদান।  ১৯৮০ সালে পাইওনিয়ার লিগ উদ্বোধন করতে আসেন ফিফার তৎকালীন সভাপতি জোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ।  তার মতো ব্যক্তিত্বও বলে গেছেন বাংলাদেশে এত সুন্দর স্টেডিয়াম আছে যা আমি ভাবতেও পারিনি। ৭০ বছরে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে যেসব স্মৃতি আছে তা পৃথিবীর অন্য স্টেডিয়ামে নেই। তাই তো বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের পরিচয় ব্যতিক্রমী ভেন্যু হিসেবেই।


তথ্যসুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন ।

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের নামকরণ ইতিহাস বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের নামকরণ ইতিহাস Reviewed by sm sohage on January 27, 2019 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.