নামকরণ ইতিহাসঃ
জগন্নাথ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান সম্প্রদায়সহ উপজাতি ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত হল। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম যে তিনটি হল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল জগন্নাথ হল তার একটি। ঢাকার বলিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরীর পিতা জগন্নাথরায় চৌধুরীর নামে এই হলের নামকরণ করা হয়।
হল সম্পর্কে আরো কিছুঃ
এই হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলেন অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, অধ্যাপক জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এই হলের প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব ও অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হত্যা করে।
আমরা জানি, ১৯২১ সালের ১ জুলাই তিনটি আবাসিক ছাত্রাবাস মুসলিম হল, ঢাকা হল ও জগন্নাথ হল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহত্তম ভূমিকা হচ্ছে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সামাজিক সংহতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা। সে ক্ষেত্রে জগন্নাথ হলই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে; ইতিহাস তারই সাক্ষ্য দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন হলের মধ্যে জগন্নাথ হলই সবার আগে নির্মিত হয়। এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশ ঘোষণার পরপরই, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই জগন্নাথ হলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, ঢাকা কলেজের মতো জগন্নাথ কলেজকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের।
জগন্নাথ হল ছিল ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকেও এই হল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ও জগন্নাথ হলের প্রথম প্রাধ্যক্ষ এই লোকায়ত চেতনার ভিত্তি রচনা করে গেছেন। আগেই উল্লেখ করেছি, নরেশ সেনগুপ্ত ছিলেন প্রগতিশীল ও সংস্কারমুক্ত। তিনি তার বন্ধু কাজী নজরুল ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের সঙ্গে জগন্নাথ হলের সম্পর্ক খুবই গভীর ছিল। জগন্নাথ হলের দ্বিতীয় প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক রমেশ চন্দ্র মজুমদারের সময়ে কবি নজরুলকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল।
জগন্নাথ হলের ছাত্ররা প্রথম থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। লাউডস্পিকার বা মাইক্রোফোন প্রথম ব্যবহার করা হয় এই হলে। জগন্নাথ হলের সঙ্গীতানুষ্ঠান শহরের সাধারণ মানুষও রাস্তায় দাঁড়িয়ে অথবা হল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে উপভোগ করত। জগন্নাথ হলেই প্রথম মেয়েদের নৃত্যানুষ্ঠান হয় বিশের দশকের শেষদিকে। মীরা দাশগুপ্ত নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন। সে সময়কার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, 'জগন্নাথ হলে আবার মেয়ে নাচিল'। জগন্নাথ হল বিচিত্র কর্মকাণ্ডে প্রাণচঞ্চল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ হলের ছাত্র সংসদের কর্মকাণ্ড ছিল শিক্ষামূলক উদ্দীপনায় ভরা। হল সংসদের সমাজসেবা সম্পাদক নামে একটি পদ এখনও আছে। জগন্নাথ হলের সমাজসেবা সম্পাদকের নেতৃত্বে ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটি বয়স্ক শিক্ষা ও নৈশ বিদ্যালয় পরিচালিত হতো। তারা শুধু নিরক্ষরতা দূর নয়; বন্যা, মহামারীর মধ্যে ত্রাণ তৎপরতা চালাতেন। দরিদ্রদের মধ্যে পুরনো শীতবস্ত্র বিতরণসহ অনেক সমাজসেবামূলক কাজও করতেন। একেবারে গোড়া থেকেই প্রতিবেশী মুসলিম হলের সঙ্গে জগন্নাথ হলের ছাত্রদের এক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। প্রথম প্রাধ্যক্ষ নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্তের এতে কম অবদান ছিল না।
তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া।দৈনিক সমকাল (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ হল, শুভাষ সিংহ রায়)।
No comments: