ঢাবির জগন্নাথ হল এর নামকরণ ইতিহাস
নামকরণ ইতিহাসঃ
জগন্নাথ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান সম্প্রদায়সহ উপজাতি ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত হল। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম যে তিনটি হল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল জগন্নাথ হল তার একটি। ঢাকার বলিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরীর পিতা জগন্নাথরায় চৌধুরীর নামে এই হলের নামকরণ করা হয়।
হল সম্পর্কে আরো কিছুঃ
এই হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলেন অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, অধ্যাপক জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এই হলের প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব ও অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হত্যা করে।
আমরা জানি, ১৯২১ সালের ১ জুলাই তিনটি আবাসিক ছাত্রাবাস মুসলিম হল, ঢাকা হল ও জগন্নাথ হল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহত্তম ভূমিকা হচ্ছে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সামাজিক সংহতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা। সে ক্ষেত্রে জগন্নাথ হলই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে; ইতিহাস তারই সাক্ষ্য দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন হলের মধ্যে জগন্নাথ হলই সবার আগে নির্মিত হয়। এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশ ঘোষণার পরপরই, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই জগন্নাথ হলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, ঢাকা কলেজের মতো জগন্নাথ কলেজকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের।
জগন্নাথ হল ছিল ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকেও এই হল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ও জগন্নাথ হলের প্রথম প্রাধ্যক্ষ এই লোকায়ত চেতনার ভিত্তি রচনা করে গেছেন। আগেই উল্লেখ করেছি, নরেশ সেনগুপ্ত ছিলেন প্রগতিশীল ও সংস্কারমুক্ত। তিনি তার বন্ধু কাজী নজরুল ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের সঙ্গে জগন্নাথ হলের সম্পর্ক খুবই গভীর ছিল। জগন্নাথ হলের দ্বিতীয় প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক রমেশ চন্দ্র মজুমদারের সময়ে কবি নজরুলকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল।
জগন্নাথ হলের ছাত্ররা প্রথম থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। লাউডস্পিকার বা মাইক্রোফোন প্রথম ব্যবহার করা হয় এই হলে। জগন্নাথ হলের সঙ্গীতানুষ্ঠান শহরের সাধারণ মানুষও রাস্তায় দাঁড়িয়ে অথবা হল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে উপভোগ করত। জগন্নাথ হলেই প্রথম মেয়েদের নৃত্যানুষ্ঠান হয় বিশের দশকের শেষদিকে। মীরা দাশগুপ্ত নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন। সে সময়কার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, 'জগন্নাথ হলে আবার মেয়ে নাচিল'। জগন্নাথ হল বিচিত্র কর্মকাণ্ডে প্রাণচঞ্চল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ হলের ছাত্র সংসদের কর্মকাণ্ড ছিল শিক্ষামূলক উদ্দীপনায় ভরা। হল সংসদের সমাজসেবা সম্পাদক নামে একটি পদ এখনও আছে। জগন্নাথ হলের সমাজসেবা সম্পাদকের নেতৃত্বে ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটি বয়স্ক শিক্ষা ও নৈশ বিদ্যালয় পরিচালিত হতো। তারা শুধু নিরক্ষরতা দূর নয়; বন্যা, মহামারীর মধ্যে ত্রাণ তৎপরতা চালাতেন। দরিদ্রদের মধ্যে পুরনো শীতবস্ত্র বিতরণসহ অনেক সমাজসেবামূলক কাজও করতেন। একেবারে গোড়া থেকেই প্রতিবেশী মুসলিম হলের সঙ্গে জগন্নাথ হলের ছাত্রদের এক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। প্রথম প্রাধ্যক্ষ নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্তের এতে কম অবদান ছিল না।
তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া।দৈনিক সমকাল (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ হল, শুভাষ সিংহ রায়)।
ঢাবির সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এর নামকরণ ইতিহাস
নামকরণ ইতিহাসঃ
১৯২১ সালে এই হলের যাত্রা শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথেই। এর মূলভবন তৈরি হয় বিশের দশকের শেষের দিকে। এই হলের প্রথম প্রোভোস্ট ছিলেন অধ্যাপক এ এফ রাহমান। এই হলের প্রথম নাম ছিল মুসলিম হল, কিন্তু পরবর্তীতে ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহের নামে এই হলের নামকরণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় দশ বছর পর নওয়াব স্যার সলিমুল্লার মৃত্যুবার্ষিকির অনুষ্ঠানে তার নামে একটা ছাত্রাবাস করার প্রস্তাব করা হয়। মুসলিম ছেলেদের জন্য তখন হল তৈরি হয়ে গেছে। প্রথমে এ হল ছিল এখনকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বিল্ডিংএ। আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দি বললেন এই হলকে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল করা হোক।
স্যার সলিমুল্লাহ সম্পর্কে
ঢাকার নবাব পরিবারে ১৮৭১ সালের ৭ই জুন সলিমুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নবাব আহসান উল্লাহ বৃটিশ, জার্মান, ফার্সী ও উর্দু গৃহশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে সলিমুল্লাহর শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ১৮৯৩ সালে তিনি ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত হয়ে ময়মনসিংহে এবং ১৮১৫ সালে বিহারের মুজাফ্ফরবাদে ও কিছুদিন ত্রিপুরায় দায়িত্ব পালন করে ইস্তাফা দেন। এরপর তিনি ময়মনসিংহে অবস্থান করেন। ১৯০১ সালের ১৬ ডিসেম্বর টেলিগ্রাম মারফত পিতা নবাব আহসানউল্লাহর ইন্তেকালের সংবাদ পেয়ে বিশেষ ট্রেনযোগে ঢাকায় ফিরে আসেন। দু’দিন পর জেষ্ঠ্য পুত্র বিধায় তিনি নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯০২ সালে বৃটিশ সরকার নবাব সলিমুল্লাহকে ‘কমান্ডার অব দ্যা স্টার অব ইন্ডিয়া (সি.এস.আই) উপাধি দেয়। ১৯০৩ সালের ১লা জানুয়ারী দিল্লীর দরবার হলে ৭ম এডওয়ার্ডের মুকুট পরিধানের রাজকীয় অনুষ্ঠানে সলিমুল্লাহ্কে “নবাব বাহাদুর” খেতাবে ভূষিত করা হয়।
ঢাকা বিভাগীয় কমিশানার স্যাভেজ ঢাকায় একটি ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এতে ব্যয় ধরা হয় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা। সরকার ত্রিশ হাজার টাকা বরাদ্ধ করে। নবাব সলিমুল্লাহ বাকী এক লক্ষ টাকা ও জমি দান করলে ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় “ঢাকা স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং। ১৯০৮ সালে নবাব সলিমুল্লাহ আরো অর্থ দান করে পিতার নামে স্কুলটির নামকরণ করেন। “আহসান উল্লাহ স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং”। ১৯৪৭ সালের পর স্কুলটি কলেজে উন্নীত হয়। মুসলিম লীগ সরকার ১৯৬২ সালে কলেজটির উন্নতি করে প্রতিষ্ঠা করে ‘পূর্ব-পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়’ যা ছিলো তদানীন্তন প্রদেশের প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীনতার পর এটির নাম করণ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি’ (বুয়েট)। নবাব সলিমুল্লাহর দান করা জমিতে বুয়েট প্রতিষ্ঠিত।
এতিম মুসলিম ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য ১৯০৮ সালে আজিমপুরে ২৮ বিঘা জমিদান করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নবাব সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা’। লেখাপড়ার জন্য এতিমখানায় ছেলেদের জন্য একটি এবং মেয়েদের জন্য একটি করে দু’টি স্কুল রয়েছে। শত শত এতিম ছেলে মেয়ের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও লেখাপড়ার যাবতীয় ব্যয় নবাব সলিমুল্লাহ মৃত্যু পর্যন্ত নিজের পকেট থেকে খরচ করেছেন। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই এতিমখানাটি বর্তমানে বিভিন্ন মানুষের দান করা অর্থে পরিচালিত হচ্ছে।
আধুনিক বা পাশ্চাত্যের শিক্ষা থেকে বিভিন্ন কারণে বঞ্চিত থাকা মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে নবাব ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। যুগোপযোগী শিক্ষার অভাবকেই মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার কারণ বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। স্যার সৈয়দ আহমেদ উচ্চ শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু নবাব সলিমুল্লাহ প্রাথমিক তথা গণশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন। ইম্পেরিয়াল লেজিসলোটভ কাউন্সিলে কংগ্রেস নেতা গোপালকৃষ্ণ গোখলে ১৯১১ সালে “বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা বিল” উত্থাপন করে। এর প্রতি ১৯১২ সালের ৩ রা মার্চ কলিকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ৫ম অধিবেশনের সভাপতির ভাষণে নবাব সলিমুল্লাহ তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ গোখলের বিলকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন। বিলটি অনুমোদিত না হওয়ায় তা কার্যকর হয়নি।
তিনি বাস্তবমুখী শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সমাজের লোকদেরকে শিক্ষাক্ষেত্রে চার শ্রেণিতে বিভক্ত করেন। যথা : ১) অভিজাত বা জমিদার শ্রেণি ২) ব্যবসায়ী ও সরকারী চাকুরী শ্রেণি ৩) কারিগর বা পেশাজীবী শ্রেণি ৪) কৃষক শ্রেণি। এই চার পেশার মানুষদের স্ব স্ব পেশায় যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতি ও ভিন্ন ভিন্ন স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। সেই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন পেশার জন্য স্বতন্ত্র পুস্তকাদি রচনা ও পাঠ্যসূচী প্রণয়নের পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ তাঁর এই পরিকল্পনা অনুসরণ করছে। শিক্ষা পরিবেশে থেকে শিক্ষার্থীরা যেন উন্নত চরিত্র গঠনের সুযোগ পায় সেজন্য আলীগড় কলেজ হোস্টেলের মতো ঢাকায় একটি মুসলিম ছাত্রবাস নির্মাণের জন্য ১,৮৬,০০০ টাকা দান করেন। এর পূর্বে বঙ্গে ছাত্রবাস নির্মাণ করার চিন্তাও কেউ করতে পারেননি। তাছাড়া ঢাকার বিভিন্ন স্কুল, মাদ্রসা ও মুসলিম বোর্ডিং এর জন্য ১৯০৫ সালেই তিনি লক্ষাধিক টাকা দান করেন।
১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারী লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী মেনে নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত নবাব সলিমুল্লাহ প্রস্তাবিত আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস ভাবে কাজ করেন। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে ভারতের বিভিন্ন নবাব ও মুসলিম জমিদারসহ বিশিষ্ঠ মুসলিম নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নবাব সলিমুল্লাহ যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ১৯১১ সালের ১৫ ও ১৬ মার্চ নবাব সলিমুল্লাহর সভাপতিত্বে তার বাসভবন আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অধিবেশনে প্রস্তাবিত আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় জন্য চাঁদা সংগ্রহ করতে নবাব সলিমুল্লাহকে প্রেসিডেন্ট এবং রেভিনিউ বোর্ডের জুনিয়ার সচিব মুহীবুদ্দিনকে সেক্রেটারি করে ‘পূর্ববঙ্গ আসাম প্রাদেশিক চাঁদা সংগ্রহ কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটির অন্যতম সদস্য শওকত আলী ও ধনবাড়ীর জমিদার সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর সহযোগিতায় নবাব সলিমুল্লাহ ১৯১১ সালের আগস্ট মাসের মধ্যে ১,৫০,০০০ টাকা চাঁদা সংগ্রহ করে আলীগড়ে প্রেরণ করেন। স্যার সৈয়দ আহমেদ (১৮১৭-১৮৯৮) ১৮৭৫ সালে আলীগড় স্কুল এবং ১৮৭৭ সালে আলীগড় কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর ২২ বছর পর বাংলাসহ ভারতের বিশিষ্ট মুসলিম নেতৃবৃন্দের ধারাবাহিক সহযোগিতায় ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। একবছর পর ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে মুসলিম সমাজে শিক্ষা বিস্তারের আপোষহীন নেতা নবাব সলিমুল্লাহর শ্রম, সহযোগিতা ও সাহায্য ইতিহাস স্বীকৃত।
বঙ্গভঙ্গ রহিত হবার পর নবাব সলিমুল্লাহ ও নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি মুসলিম প্রতিনিধি দল ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারী ঢাকা সফররত ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। আলোচনার সময় নবাব সলিমুল্লাহ তাঁর পুরনো দাবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে মুসলিম শিক্ষা ব্যবস্থা তদারকীর জন্য মুসলিম শিক্ষা কর্মকর্তা এবং আনুপাতিক হারে মুসলিম শিক্ষক নিয়োগের দাবী জানান। নবাবের এই দুইটি দাবী ভাইসরয় মেনে নেন এবং সংখ্যানুপাতে মুসলিম শিক্ষা অফিসার এবং সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩৩ শতাংশ মুসলিম শিক্ষক নিয়োগের নির্দেশ দেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় অর্ধেক পদও পূরণ হয়নি।
স্কুলগুলোতে মুসলিম শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে নবাবের যুক্তি ছিলো যে, অমুসলিম শিক্ষকদের সংস্কৃত ঘেষা বাংলা ভাষা মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য কিছুটা অন্তরায় সৃষ্টি করে। এ সম্পর্কে ১৯০৮ সালে পাঞ্জাবের অমৃতসরে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের ২২তম অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে নবাব সলিমুল্লাহ বলেনঃ “বাংলাদেশে শহরের ছেলে পুলেরা সাধারণ উর্দুতেই কথা বলে, আর শহরতলী বা গ্রামে ব্যবহৃত হয় মুসলিম বাংলা ভাষা যা হিন্দুদের ব্যবহৃত বাংলা ভাষা থেকে স্বতন্ত্র। তাই সরকারী স্কুলগুলোতে মুসলিম শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে”। ৫৫২ বছরের মুসলিম শাসনের সময় মুসলিম সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্য দুটি সমান্তরাল পথে বিকশিত হয়েছে। এর একটি হচ্ছে আরবী ও ফার্সী শব্দাবলী নির্ভর ‘মুসলিম বাংলা সাহিত্য’ এবং অপরটি সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃত শব্দাবলী প্রভাবিত ‘হিন্দু বাংলা সাহিত্য’। এই দু’টি ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে।
১৯০৪ সালের ১১ জানুয়ারী আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় নবাব সলিমুল্লাহর দেয়া আসাম প্রদেশ, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ এবং দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার নিয়ে নতুন প্রদেশ গঠনের প্রস্তাবটি মেনে নিয়ে বৃটিশ সরকার ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর গঠন করে ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ’। নতুন প্রদেশের অবিসংবাদী নেতা হিসাবে নবাব সলিমুল্লাহ শিক্ষা বিস্তারকে প্রাধান্য দেন। ১৯০৫ সালেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিপুল অর্থ দান করেন। শিক্ষা সম্মেলন, শিক্ষা সমিতি, সর্ব ভারতীয় ও প্রদেশিক মুসলিম লীগ গঠনের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করে ১৯১৩ সালে তিনি ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন। বৃটিশ সরকার তার জমিদারীর দায়িত্ব গ্রহন করে ‘কোর্টস অব ওয়ার্ড’ গঠন করে এবং জমিদারীর আয় থেকে তাকে মাসোহারার ব্যবস্থা করে। বাংলা তথা বৃটিশ ভারতের মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারের উন্নয়নের ক্ষেত্রে ও তাদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করে নবাব সলিমুল্লাহ নিঃস্ব হয়ে পড়েন।
বৃটিশ ভারতের অধিকার বঞ্চিত মুসলমানদের জন্য তার সবচেয়ে বড় অবদান ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে শত বছরের শোষনের ফলে তালানীতে পৌঁছে যাওয়া ভারতীয় মুসলমানদের ঔক্যবদ্ধ করেছে মুসলিম লীগ। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগের বাগান বাড়ীতে গঠিত হবার পর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই দলের পতাকা নিয়ে মুসলিম স্বার্থ রক্ষায় রাজনীতি করেছেনঃ মহামান্য আগাখান (১৮৭৭-১৯৫৭), কংগ্রেসের সাবেক নেতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬-১৯৪৮), নবাবজাদা লিয়াকতম আলী খান (১৮৯৫-১৯৫১), শের-এ-বাংলা একে ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২), হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩), খাজা নাজিমউদ্দিন (১৮৯৪-১৯৬৪), মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাষানী (১৮৮০-১৯৭৬), পন্ডিত আবুল হাশিম (১৯০৫-১৯৭৪), ফজলুল কাদের চৌধুরী (১৯১৯-১৯৭৩), খান এ সবুর (১৯০৮-১৯৮২), শেখ মুজিবর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। উপমহাদেশে মুসলিম রাজনীতিবিদ সৃষ্টির পেছনে রয়েছে নবাব সলিমুল্লাহ ও তার গঠিত মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক অবদান।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের কলকাতা প্রবাসী জমিদারগণের এবং ভারতীয় কংগ্রেসের প্রচ- বিরোধীতা ও মাষ্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে পরিচালিত সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ফলে বৃটিশ স¤্রাট পঞ্চম জর্জ ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লির দরবার হলে বঙ্গভঙ্গ রহিত করেন। এতে বাংলার মুসলমানরা আশাহত হয়ে পড়ে, আর উল্লসিত হয় বাংলার বর্ণবাদী হিন্দু নেতারা। ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারী নবাব সলিমুল্লাহর প্রস্তাব মেনে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষনা করেন। ‘পূর্ববঙ্গের চাষা-ভূষা মুসলমানদের’ উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেয়ার স্বার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নবাব সলিমুল্লাহ দুইশত বিঘার বেশী জমি দান করেন। তার দান করা জমিতে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাব সলিমুল্লাহর জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী কখনো পালন করা হয় না। অকৃতজ্ঞতা আর কাকে বলে।
বঙ্গভব্দ রহিত হবার পর থেকেই নবাব সলিমুল্লাহ স্বপ্নভঙ্গের ব্যাধিতে ভুগতে থাকেন। এ.কে.ফজলুল হককে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত করে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারী কলিকাতা থেকে তাঁর ঢাকা ফেরার কথা ছিলো।
তিনি ফিরলেন, তবে জীবিতাবস্থায় নয়। ১৬ জানুয়ারী রাত ২-৩০ মিনিটে তাঁর কলিকাতার চোরঙ্গী রোডস্থ ৫৩ নং বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন। ১৬ জানুয়ারী বিকাল চারটায় কলিকাতায় আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন ওয়েলসলী স্কোয়ার পার্কে নামাজে জানাযা শেষে ১৭ জানুয়ারী নবাব সলিমুল্লাহর লাশ ঢাকায় আনা হয়। ঢাকায় দু’টি জানাযা শেষে নবাবকে দাফন করা হয় বেগম বাজার পারিবারিক গোরস্থানে। নবাবের মৃত্যৃ আজো রহস্যে ঘেরা।
ঢাবির ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল এর নামকরণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী হল। প্রথমে এই হলের নাম ছিল ঢাকা হল। ১৯৬৯ সালে এশিয়ার বিখ্যাত পণ্ডিত, জ্ঞানতাপস ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহের নামানুসারে এই হলের নাম করণ করা হয় শহীদুল্লাহ্ হল। পরে ১৭ জুন, ২০১৭ তারিখে এই হলের নাম ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল করা হয়।
১৭ জুন ২০১৭ তারিখ শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সিনেট অধিবেশনে এই পরিবর্তন আনা হয়।
অধিবেশনে শহীদুল্লাহ হলের নাম পরিবর্তনের বিষয়টি সিনেটে উত্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। সিনেট সদস্যরা এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করলে নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়।
সিদ্ধান্তটি পাস হওয়ায় পর উপাচার্য বলেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাদেশের একজন গুণীজন ছিলেন। কিন্তু এত দিন হলটির নাম ‘শহীদুল্লাহ হল’ ছিল, তাতে কোন শহীদুল্লাহর নামে এই হলের নামকরণ করা হয়েছে, সেটি স্পষ্ট বোঝা যেত না। তাই তা পরিবর্তন করে আজ ‘ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল’ নাম করা হলো।
ঐতিহাসিক বিবরণঃ
১৯৫২ সালে এই পুকুর ঘাটে বসেই ১৪৪ ধারা ভেঙে ভাষা আন্দোলনের মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৭১ সালের মার্চ ২৫ রাতে এই হলের পাশেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। যার ফলে ক্ষিপ্ত পাক সেনারা সর্বপ্রথম হত্যাকাণ্ডটি চালায় এই হলে ঢুকে। সেই রাতে বর্বর পাক সেনাদের হাতে খুন হন এ হলের আবাসিক শিক্ষক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আতাউর রহমান খান খাদিম সহ আরো অনেকে।
শহীদুল্লাহ হল এলাকার পূর্বের নাম ছিল বাগ-এ-মুসা খাঁ। এটি বারো ভূইয়াঁর অন্যতম ভূইয়াঁ ঈসা খাঁর পুত্র মুসা খাঁয়ের নামে নামাঙ্করণ করা হয়। মুসা খাঁ সুবেদার ইসলাম খাঁয়ের নিকট যুদ্ধে হেরে যাবার পর যুদ্ধাবন্দী হিসেবে আটক ছিল। তবে সুবেদার ইসলাম খাঁ তার প্রতি বেশ সহৃদয় ছিল। হাকিম হাবিবুর রহমানের মতে এটি একটি বাগান ছিল যা মুসলিম বাগান হিসেবেও বিখ্যাত ছিল। সেই সময়ের নিদর্শন হিসাবে রয়েছে মুসা খাঁয়ের মসজিদ, এবং সমাধি।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সম্পর্কেঃ
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৮৮৫-১৯৬৯) শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও ভাষাতত্ত্ববিদ। ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা মফিজউদ্দীন আহমদ ছিলেন পীর গোরাচাঁদের দরগাহর খাদেম। পৈতৃক পেশা থেকে বেরিয়ে ব্যতিক্রমী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভাষা ও জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হন। তিনি ছোটবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে উর্দু, ফারসি ও আরবি শেখেন এবং স্কুলে সংস্কৃত পড়েন। হাওড়া জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা (১৯০৪) এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ (১৯০৬) পাস করার পর তিনি হুগলি কলেজে পড়াশোনা করেন (১৯০৬-৮)। কিন্তু অসুস্থতার কারণে অধ্যয়নে সাময়িক বিরতির পর তিনি কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বি.এ (১৯১০) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ (১৯১২) পাস করেন। দুবছর পর তিনি বি.এল (১৯১৪) ডিগ্রিও অর্জন করেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ যশোর জেলা স্কুলের শিক্ষক (১৯০৮-০৯) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন; তারপর সীতাকুন্ড হাইস্কুলে কিছুদিন প্রধান শিক্ষকের (১৯১৪-১৯১৫) দায়িত্ব পালন করার পর তিনি চবিবশ পরগনা জেলার বশিরহাটে আইন ব্যবসায়ে (১৯১৫-১৯) নিযুক্ত হন। এখানে তিনি পৌরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে শরৎচন্দ্র লাহিড়ী গবেষণা-সহকারী (১৯১৯-২১) হিসেবে কাজ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে (১৯২১) যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা তাঁর জীবনের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এখানে শিক্ষাদান কালে তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে মৌলিক গবেষণা করেন এবং ১৯২৫ সালে প্রমাণ করেন যে, গৌড়ী বা মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।
১৯২৬ সালে শহীদুল্লাহ্ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ইউরোপ যান। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বৈদিক ভাষা, বৌদ্ধ সংস্কৃত, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, তিববতি ও প্রাচীন পারসিক ভাষা এবং জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন খোতনি, প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা শেখেন। ১৯২৮ সালে তিনি বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদাবলি বিষয়ে গবেষণা করে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরই ধ্বনিতত্ত্বে মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমাও লাভ করেন এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। অতঃপর সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগ ভেঙ্গে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ হলে ১৯৩৭ সালে তিনি বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ হন এবং ১৯৪৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগীয় প্রধান ও কলা অনুষদের ডীন হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ (১৯২২-২৫) ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে (ফরাসি ভাষার) খন্ডকালীন অধ্যাপক (১৯৫৩-৫৫) হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫-৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস নিযু্ক্ত হন।
অধ্যাপনার বাইরে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ করাচির উর্দু& উন্নয়ন সংস্থার ‘উর্দু অভিধান প্রকল্প’, (১৯৫৯-৬০), ঢাকার বাংলা একাডেমীর ‘পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্প’ (১৯৬০) এবং ‘ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্প’-এ (১৯৬১-৬৪) সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক (১৯২১-২৫), ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রভোস্ট (১৯৪০-৪৪), ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য (১৯৬৩-৬৪), ইসলামিক একাডেমীর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য (১৯৬৩-৬৪), বাংলা একাডেমীর বাংলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ও দাউদ সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী চেয়ারম্যান ছিলেন।
ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে শহীদুল্লাহ্ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনিই প্রথম উর্দুর পরিবর্তে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিক দাবি জানান। তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক (১৯১১) ছিলেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা ও সম্মেলনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলন (১৯১৭), ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ সম্মেলন (১৯২৬), কলকাতায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম যুবক সম্মেলন (১৯২৮), হায়দ্রাবাদে নিখিল ভারত প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলন (ভাষাতত্ত্ব শাখা, ১৯৪১) এবং পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন (১৯৪৮)। মাদ্রাজে ‘ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার অন ট্রাডিশনাল কালচার ইন সাউথ-ইস্ট এশিয়া’ অনুষ্ঠানে তিনি ইউনেস্কোর প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তার চেয়ারম্যান মনোনীত হন।
ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে শহীদুল্লাহ্র বহু মননশীল ও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ নানা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেন। আল এসলাম পত্রিকার সহকারী সম্পাদক (১৯১৫) ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক (১৯১৮-২১) হিসেবে তিনি যোগ্যতার পরিচয় দেন। তাঁরই সম্পাদনা ও প্রকাশনায় মুসলিম বাংলার প্রথম শিশুপত্রিকা আঙুর (১৯২০) আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়াও তিনি ইংরেজি মাসিক পত্রিকা দি পীস (১৯২৩), বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা বঙ্গভূমি (১৯৩৭) এবং পাক্ষিক তকবীর (১৯৪৭) সম্পাদনা করেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস রচনাসহ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বহু জটিল সমস্যার সমাধান করেন। বাংলা লোকসাহিত্যের প্রতিও তিনি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। গবেষণাগ্রন্থের পাশাপাশি তিনি সাহিত্য এবং শিশুসাহিত্যের অনেক মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেন। তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ অনুবাদ ও সম্পাদনাও করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো: সিন্দবাদ সওদাগরের গল্প (১৯২২), ভাষা ও সাহিত্য (১৯৩১), বাঙ্গালা ব্যাকরণ (১৯৩৬), দীওয়ান-ই-হাফিজ (১৯৩৮), শিকওয়াহ ও জওয়াব-ই-শিকওয়াহ (১৯৪২), রুবাইয়াত-ই-উমর খয়্যাম (১৯৪২), Essays on Islam (১৯৪৫), আমাদের সমস্যা (১৯৪৯), পদ্মাবতী (১৯৫০), বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খন্ড ১৯৫৩, ১৯৬৫), বিদ্যাপতি শতক (১৯৫৪), বাংলা আদব কী তারিখ (১৯৫৭), বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (১৯৫৭), বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত (১৯৫৯), কুরআন শরীফ (১৯৬৩), অমরকাব্য (১৯৬৩), সেকালের রূপকথা (১৯৬৫) ইত্যাদি। তাঁর সম্পাদিত আঞ্চলিক ভাষার অভিধান এক বিশেষ কীর্তি। মুহম্মদ আবদুল হাই -এর সঙ্গে তাঁর যুগ্ম-সম্পাদনায় রচিত Traditional Culture in East Pakistan (১৯৬১) একখানা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তাঁর Buddhist Mystic Songs (১৯৬০) গ্রন্থটি চর্যাপদের অনুবাদ ও সম্পাদনা কর্ম। তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে চর্যাপদ সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় রচিত; এর ধর্মতত্ত্ব নিয়েও তিনি আলোচনা করেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন বহুভাষাবিদ এবং ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন। তিনি ১৮টি ভাষা জানতেন; ফলে বিভিন্ন ভাষায় সংরক্ষিত জ্ঞানভান্ডারে তিনি সহজেই প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান; তাঁর ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে ধর্ম সম্পর্কে তাঁর আন্তরিক বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি ইসলামের প্রকৃত তাৎপর্য তুলে ধরার জন্য গ্রামে-গঞ্জে ওয়াজ-মাহফিলে বক্তৃতা করতেন।
জীবনভর ভাষা ও সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘প্রাইড অফ পারফরম্যান্স’, ফরাসি সরকার কর্তৃক ‘নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্ট লেটার্স’ (১৯৬৭) উপাধিতে ভূষিত হন। ‘জ্ঞানতাপস’ হিসেবে পরিচিত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ঢাকায় পরলোক গমন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ্ হল চত্বরে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া, প্রথম আলো ও বাংলাপিডিয়া।